পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন

১৩ নভেম্বর, ২০১৪, ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ
আমাদের অঙ্গীকার
আমরা, সহস্রাধিক নারী সংগঠক, যারা বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর সদস্য, দেশের বিভিন্ন প্রান- থেকে আজ ১৩ নভেম্বর, ২০১৪ ঢাকায় সমবেত হয়েছি। আমরা ইতোমধ্যে নিজ এলাকায় আমাদের, বিশেষ করে নারীদের জীবনমানের উনয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি এ সফলতাগুলো উদ্‌যাপন, আমাদের সংগ্রামের অভিজ্ঞতাগুলো বিনিময় এবং একইসঙ্গে ভবিষ্যত কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে।
আমরা জানি যে, প্রসূতি মা ও নবজাতক শিশুর মৃত্যুহার কমানো, টিকাদানসহ শিশুদের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ এবং তাদের সার্বিক জীবনমানের উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি যথেষ্ট ইতিবাচক। কিন’ একইসঙ্গে আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, সারা দেশে নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতা ব্যাপক হারে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ-এর তথ্যমতে, চলতি বছরের (২০১৪) জানয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন- গত ছ’মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫ জনকে। ইউনিসেফ-এর সামপ্রতিক দুটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিবাহ ও কিশোরী নির্যাতনের দিক থেকে শীর্ষে বাংলাদেশ। দেশে এখনও ৬৬ শতাংশ বিয়েতেই কনের বয়স থাকে ১৮ বছরের নীচে। এছাড়াও বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক নারী ও কন্যাশিশু ক্ষুধা, অপুষ্টি ও পাচারের শিকার। সমাজের বিভিন্ন স-রে সিদ্ধান- গ্রহণ, সুযোগ ও মৌলিক সেবা গ্রহণে নারীদের অভিগম্যতা ও সম-অংশগ্রহণের সুযোগ অত্যন- সীমিত। এই সম্মেলন থেকে আমরা ঘোষণা করছি যে,এ সকল অন্যায্য ও অমানবিক অবস্থা অবসানের লক্ষ্যে এবং নারী তথা সকল নাগরিকের জন্য সমৃদ্ধ ও আত্নমর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যত গঠনে বদ্ধ পরিকর।
আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সমাজের প্রতিটি স-রে নারীদের থাকবে সম-সুযোগ এবং সিদ্ধান- গ্রহণ প্রক্রিয়ায় থাকবে তাদের অন-র্ভূক্তি ও সম-অংশগ্রহণ। সকলের জীবন হবে নিরাপদ ও বৈষম্যহীন। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের, বিশেষত নারীদের সচেতন, সক্রিয় ও সংগঠিত করে তাদের অন-র্নিহিত ক্ষমতা ও সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে এমন একটি আত্মনির্ভরশীল ও আত্নমর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যৎ অর্জন করা সম্ভব। এই প্রত্যাশাকে ধারণ করে, তৃণমুলে নারী নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে আমরা যে গণজাগরণ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি তা বেগবান করার লক্ষ্যে এই সম্মেলন থেকে আমরা কতকগুলো কর্মসূচি স্বেচ্ছায়  বাস-বায়নের অঙ্গীকার করছি।

আমরা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি যে,
১। ‘বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক’-এর একনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমরা প্রত্যেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে নিজেদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও অন-র্নিহিত শক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাবো, যাতে ক্ষুধামুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গঠনে আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়ে উঠি।
২। সমমনা অন্য নারীদের সংগঠিত ও তাদের নেতৃত্ব বিকাশের জন্য আমরা সুযোগ সৃষ্টি করব, যাতে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে ওঠে। এই নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করার জন্য পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে আমরা স্থানীয় নারী সংগঠন গড়ে তুলব এবং তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করব।
৩। গণতন্ত্র, সুশাসন ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার একটি অন্যতম প্রধান শর্ত হলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। তাই স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন- সকল স-রে সিদ্ধান- গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। সকল স-রের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লক্ষ্যে আমরা নিজেদেরকে প্রস’ত করে তুলব। একই সঙ্গে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীগণ যাতে নির্বাচিত হন, সে লক্ষ্যে জনগণ, বিশেষত নারীদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করব।
৪। আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে শিশুবিবাহ, যৌতুক, নারী ও শিশু পাচার এবং পারিবারিক নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সকল সহিংসতার বিরুদ্ধে  রুখে দাঁড়াব, বিশেষ করে ১৮ বছরের আগে যাতে কোন কন্যাশিশুর বিয়ে না হয় তার জন্য সর্বোচ্চ প্রচার-প্রচারণা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলব।
৫। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, পুষ্টির উন্নয়ন, বিষেশত মা ও শিশুর এবং পরিবেশবান্ধব কৃষি আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আমরা নিজ নিজ এলাকায় সামাজিক গণজাগরণ গড়ে তুলব।
৬। সরকারের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্পদ, সেবা ও ন্যায্য অধিকারসমূহ জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ গুরু  ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি ও মৌলিক সেবায় নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিতকল্পে ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে জোরালো এডভোকেসি চালিয়ে যাবো।
৭। সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ও নিরাপদ পানির ব্যবহার, গর্ভবতী মায়ের যত্ন ও নিরাপদ মাতৃত্ব, প্রতিটি শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি, জন্ম ও বিবাহ নিবন্ধন নিশ্চিতকরণ এবং আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে আমরা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করব।
৮। ‘কন্যাশিশু বোঝা নয়, বরং সম্পদ’ – এ বোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করব, যাতে করে জন্মের পর থেকেই কন্যাশিশু্‌র সকল সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত হয়। একই সাথে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া রোধ করাসহ কন্যাশিশুর সকল অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের প্রতিভা বিকাশের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করব।
৯। বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর সদস্য হিসেবে আমরা নিজ নিজ এলাকায় জাতীয় ও আন-র্জাতিক দিবসসমূহ উদ্‌যাপনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করব। বিশেষত, আন-র্জাতিক নারী দিবস, জাতীয় কন্যাশিশু দিবস, আন-র্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস, বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ও বেগম রোকেয়া দিবস অত্যন- গুরুত্বের সাথে পালন করব।

পরিশেষে, আজকের এ সম্মেলন থেকে বিয়ের বয়স কমানো সংক্রান- সরকারের সাম্প্রতিক প্রস্থাবের তীব্র প্রতিবাদ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর বহাল রাখার আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।

download
ঘোষণা পত্র বাংলা পিডিএফ ডাউনলোড
download
ঘোষণা পত্র ইংরেজি পিডিএফ ডাউনলোড