”আসুন, সবাই মিলে শপথ করি, স্থানীয়ভাবে করোনা সহনশীল গ্রাম গড়ে তুলি” সারাবিশ্ব কাঁপছে এখন করোনার ভয়ে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। ০৮ মার্চ ২০২০ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে এই সংখ্যা। করোনাকে জয় করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গ্রামীণ জনপদের মানুষও এগিয়ে এসেছে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য। যারা নিবেদিতভাবে সমাজে মানুষের মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সমাজে মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখছেন, তারা প্রতি নিয়ত ছুটে চলেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। মুরশিদাৎ খ্যাত এই ত্রাতাদের পদচারণায় করোনা ভীতি থেকে ক্রমাগত উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে জনগোষ্ঠির পিছিয়ে পড়া মানুষটিও। যারা এগিয়ে এসেছেন তাদেরই এজন মুসলিমা বেগম।
নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলাধীন পাটিচরা ইউনিয়নের রসকানাই গ্রামে বসবাস করেন নারীনেত্রী মুসলিমা বেগম। তিনি দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশের বিকশিত নারী নেটাওর্য়াকের পাটিচরা ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক। করোনা ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ শুরু হলে, তিনি রসকানাই গ্রাম উন্নয়ন দলের সদস্যদের নিয়ে একাধিক সভা করেন। সভায় পরিকল্পনা করা হয়, গ্রামের মানুষকে গুজব, অপ-প্রচার রোধ এবং স্বাস্থ্য সচেতন করে তোলা হবে এবং সামর্থ্য মোতাবেক সহায়তা করা হবে। এছাড়াও গ্রামে যাতে বহিরাগত কেউ আসতে না পারে এবং গ্রামের কেউ বাইরে থেকে ফিরে আসলে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হবে। মুসলিমার নেতৃত্বে গ্রামে হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম শেখানোর প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তারা রসকানাই গ্রামকে ৬টি পাড়ায় বিভক্ত করে প্রত্যেক বাড়িতে, নলকুপে এবং ট্যাপে হাত ধোয়ার জন্য সাবান নিশ্চিত করেন। এছাড়াও গ্রামের বিভিন্ন রাস্তায়, মাদ্রাসা ও মসজিদে জীবানুনাশক ছিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সচেতন করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য দি হাঙ্গার প্রজেক্ট থেকে প্রাপ্ত ৭০টি লিফলেট বিতরণ করেছেন। তাঁদের নেতৃত্বে গ্রামের মানুষকে হাত ধোয়ার জন্য ২টি বেসিন স্থাপন করেন। মানুষকে মাস্ক ব্যবহারের গুরুত্ব এবং প্রত্যেকের মাস্ক নিশ্চিত করতে ৬১টি পরিবারের মাঝে মাস্ক বিতরন করেছেন। ঢাকা, নারায়নগঞ্জ এবং গাজিপুরে গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেলে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ গ্রামে ফিরে আসে। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৬জনের বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছেন। করোনা সন্দেহ হলে ৩জনের পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। করোনা সন্দেহজনক রোগিকে কেউ যেন অবজ্ঞা না করে সে জন্য মসজিদে আলোচনা করারও ব্যবস্থা করেছেন। অপপ্রচার, গুজব এবং অপতথ্য থেকে এলাকার মানুষকে রক্ষা করতে এলাকায় মাইকিং করেছেন। মসজিদে জুম্মার নামাজের আগে খতিবকে দিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করিয়েছেন। নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সমন্বয় করে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।রসকানাই মাদ্রাসায় সারাদিন তাসখেলা চলছিল এবং মানুষ বিশৃংখলা করতো। তরুণদের সহায়তায় পুলিশকে খবর দিয়ে সে আড্ডা বন্ধ করে দেন। রসকানাই গরিবপাড়ার আঙ্গুরী বেগমের স্বামীর সাথে চলমান বিবাদ মিমাংসা করে দেন। এখন তারা শান্তিতে বসবাস করছে। অতিদরিদ্র ও দরিদ্র মানুষের সহযোগিতার জন্য তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা রসকানাই মহিলা গণগবেষণা সমিতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, এনজিও এবং স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে প্রায় ১লক্ষ ১২ হাজার টাকা সংগ্রহ করে ৭ দফায় এলাকার ১৮৭টি পরিবারের মাঝে ত্রান বিতরণ করেন। অতিদ্ররিদ্র ৬১টি পরিবারকে ঈদ সামগ্রী হিসেবে সেমাই, চিনি, আটা, গুড়ো দুধ, ছোলা, সাবান বিতরণ করেন। ব্র্যাক ব্যাংক এর সাথে যোগাযোগ করে ৮টি পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে গরু ক্রয়ের জন্য এককালিন অর্থ সহায়তা পাইয়ে দেন। এই সময়ে শিশু, বয়স্ক ও গর্ভবতী মায়েরা অনেক ঝুঁকিতে থাকে। তাই গর্ভবতীর ঝুঁকি কিছুটা লাঘবের জন্য ১৭২ জন গর্ভবতী মা ও শিশুকে ১কেজি করে গুড়োদুধ প্রদান করেছেন।
অতিমহামারির এই সময়ে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং ক্রমাগতভাবে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে থাকে। আগামির অনাকাঙ্খিত টানাপোড়েন থেকে পরিবারগুলোকে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গ্রামের ৩৬টি পরিবারকে শাক এবং সবজি বীজ প্রদান করেছেন। নিজেদের উৎপাদিত কীটনাশকমুক্ত শাক-সবজি গ্রামের আরো ১০৮টি পরিবারের মাঝে বিতরণ করেছেন। এছাড়াও শাক-সবজি থেকে যে বীজ আসবে তা নিজেদের বীজ ব্যাংকে প্রদান করে পুরো এলাকার শতভাগ মানুষকে পতিত জমি ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী করে তুলবেন বলে আকাংখা ব্যক্ত করে। নিজের আম বাগানের আম বিক্রয় না করে ৫০টি পরিবারের মাঝে ১কেজি করে বিতরণ করেন। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সমন্বয় করে গ্রাম উন্নয়ন দলের সভার মাধ্যমে বাছাইকৃত ১৩ টি পরিবারকে সরকারী খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সহায়তা পাইয়ে দিয়েছেন। নিজের দোকান থেকে সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি এবং মাথা ব্যাথার ঔষধ বিতরণ করেছেন এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্য সহকারীর মাধ্যমে গ্রামে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব তুলে ধরে শারীরিক দুরত্ব মেনে আলোচনা সভা আয়োজন করেছেন।
মুসলিমা বেগম এবং রসকানাই গ্রাম উন্নয়ন দলের নেতৃত্বে পরিচালিত কার্যক্রমের ফলে এখন পর্যন্ত এখানে কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। পরিকল্পিত পথে এগিয়ে গিয়ে সকলের জন্য নিরাপদ জীবন উপহার দেবার আকাংখা এবং সারাক্ষণ মানুষের পাশে থাকার ঐকান্তিক ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মুসলিমা বেগম। মানুষ বাঁচে তাহার কর্মে, বয়সের মধ্যে নয়, নারীনেত্রী মুসলিমা তা প্রমাণ করে চলেছেন। পরিবারের সদস্য এবং নিকটাত্মীয়রাও মুসলিমাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। মুসলিমার গতিশীল নেতৃত্বে করোনা সহনশীল গ্রাম হিসেবে রসকানাই কাঙ্খিত উন্নয়নের পথে এগিয়ে থাকবে এটাই সবার প্রত্যাশা।