করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী এক নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি দেশ এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে এবং নিজেদের দেশবাসীকে রক্ষায় আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম সনাক্ত হয়। প্রতিষেধক বিহীন এই ভাইরাসের লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় বিষয়ে শহর, গ্রাম সর্বত্রই আলোচনা হতে থাকে। এই আলোচনার সাথে গুজব ও ভুল তথ্যও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি মানুষ বিভ্রান্তি আর আতঙ্কে আক্রান্ত হয় বেশি। কাজেই, সর্বত্রই মানুষকে সচেতন হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
এমন বিপদের কালে, সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে সাহস ও দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে সচেতন করতে পারলেই, দেশের মানুষ করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করে করোনাসহিষ্ণু গ্রাম গড়তে সক্ষম – এমনটাই বিশ্বাস করেন মাদারীপুরের ফাতেমা বেগম।
সদর উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নে ফাতেমা বেগম সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনে একটানা ২৭ বছর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নির্বাচিত সদস্য হিসেবে উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। সকল প্রশিক্ষণেই তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার বিষয়ে আলোচনা শুনেছেন। সেই অনুযায়ী চেষ্টা এবং চর্চাও করেছেন। কিন্তু, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ প্রশিক্ষণ তার চেতনায় পরিবর্তন এনেছে। এ প্রশিক্ষণে তিনি শিখেছেন, মনের শক্তিই বড়ো শক্তি। আর এই আত্মশক্তির জোরে তিনি ‘বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক’-এর মাদারীপুর জেলা কমিটির সভাপতি এবং ‘সৌহার্দ্য নারী কল্যাণ ফাউন্ডেশন’-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২০২০ সনের শুরুতেই বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের খবর রাখতেন ফাতেমা বেগম। একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে এটা তার দায়িত্ব মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে সংক্রমণের পরপরই তিনি চারিদিকে মানুষকে মাথা ন্যাড়াসহ বিভিন্ন লতা-পাতার রস পান করতে দেখে চিন্তিত হয়ে উঠেন। বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করে মানুষকে সচেতন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেই মোতাবেক গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতাবৃদ্ধিমূলক উঠান বৈঠক করতে থাকেন। এ সকল উঠান বৈঠকে বার বার হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পুষ্টিকর ও ভিটামিন সি যুক্ত খাদ্য গ্রহণ, অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে না যাওয়া এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরেন। নিজের খরচে কাপড়ের মাস্ক তৈরি করে এ সকল উঠান বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে তিনি বিতরণ করেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারিভাবে ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করা হয়। এর ফলে, সারা দেশের ন্যায় পিয়ারপুর ইউনিয়নেও হতদরিদ্র অসংখ্য পরিবার কর্মহীন হয়ে যান। কর্মহীন এ সকল পরিবারে কোনো আয়-রোজগার না থাকায় এই পরিবারের সদস্যগণ মানবেতরভাবে জীবনযাপন করেন। এলাকার অসহায় মানুষেরা সাহায্যের আশায় ফাতেমা বেগমের কাছে ছুটে আসেন। দরিদ্র মানুষের শেষ ভরসা তিনি। ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে বিগত ২৭ বছর তিনি মানুষের ভরসার মর্যাদা দিয়েছেন, বিপদে মানুষের পাশে থেকেছেন। পিয়ারপুর ইউনিয়নে তিনি সৌহার্দ্যের ও মানবতার প্রতীক হয়ে আছেন। পূর্বের ন্যায় এই বিপদের দিনেও তিনি গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজের সন্তানদের আর্থিক সহায়তায় তিনি ১০০ হতদরিদ্র পরিবারে খাদ্য (পরিবার প্রতি চাল ৫ কেজি, ডাল ১ কেজি, পিয়াঁজ ১ কেজি, আলু ১ কেজি ও ২টি সাবান) বিতরণ করেন। তাছাড়া ৪৫টি প্রতিবন্ধী পরিবারের মাঝে রোজায় ইফতারের সামগ্রী (ছোলা ১ কেজি, মুড়ি ১ কেজি, চিড়া ১ কেজি, চিনি ১ কেজি ) ও নগদ ৪০,০০০ হাজার টাকা বিতরণ করেন। একই সাথে ৫টি দুস্থ পরিবারের জন্য মাদারীপুর পৌরসভার ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে খাদ্য সামগ্রী (ডাল ৫ কেজি, তেল ২ লিটার, চিনি ২ কেজি) কিনে দিয়েছেন। পিয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাথে যোগাযোগ করে আরো ১৫ জনের খাদ্য সামগ্রী পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
ফাতেমা বেগম শুধু খাদ্য সহায়তা করেই থেমে থাকেননি। বরং যোগ্য নেতার মতো সুদূর প্রসারী চিন্তা করেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি কৃষিকাজে মনোনিবেশ করতে হবে। কেননা, খাদ্য উৎপাদন না হলে দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিবে। আর তাই, বিএডিসি-এর সাথে যোগাযোগ করে তিনি কৃষকদের জন্য উন্নত জাতের কৃষিবীজ ও সারের ব্যবস্থা করেছেন। পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে সবজি চাষে নারীদের উদ্বুদ্ধ করে বিভিন্ন জাতের সবজি বীজ বিতরণ করেছেন।
প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান আর দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে আজ ফাতেমা বেগম বিশ্বাস করেন যে, শুধু নিজে বাঁচলে হবে না, বরং বাঁচতে হবে সকলকে। বাঁচাতে হবে পুরো গ্রামকে। আর এ কারণে মানবতার সেবায় সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেকে উজ্জীবিত করে দশকে সাথে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টাতেই গড়ে উঠবে ’করোনাসহিষ্ণু’ গ্রাম, আর এভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।