আত্মপ্রত্যয়ী সন্ধ্যা রাণীর উদ্যোগে আলোকিত হয়েছে মানবতার পথ

করোনাভাইরাস – সারা বিশ্বে বর্তমানে সর্বাধিক উচ্চারিত একটি শব্দগুচ্ছ। শহর বা গ্রাম সর্বত্রই আলোচনার বিষয় এই করোনাভাইরাস। মার্চ মাসে বাংলাদেশে এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী সনাক্ত হওয়া ও আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর সারা দেশের মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে সংক্রমণের সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ে মানুষের আতঙ্ক।

এমনই আতঙ্কময় পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এবং আতঙ্কিত মানুষের মাঝে সাহস সঞ্চারে এগিয়ে আসেন আমাদের সমাজেরই একদল স্বেচ্ছাব্রতী মানুষ। কোনো প্রশংসা প্রাপ্তির আশায় নয়, বরং মানবসেবার নেশায় এই স্বেচ্ছাব্রতী মানুষেরা আত্ম-উপলব্ধি ও আত্ম-প্রত্যয়ের সাথে সকল প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ করেন।

বাংলাদেশের উত্তরের জনপদ তিস্তা নদী বিধৌত রংপুরের সদর উপজেলার অন্তর্গত ইউনিয়ন খলেয়া। প্রান্তিক সীমানায় বসবাস করে শুধুমাত্র আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজ গ্রামকে করোনাভাইরাস মুক্ত রেখেছেন এ গ্রামেরই একজন নারী স্বেচ্ছাব্রতী – তিনি হলেন সন্ধ্যা রাণী।

দি হাঙ্গার প্রজেক্ট এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের ফলে সন্ধ্যা রাণী উপলব্ধি করেন যে, একজন নারী হিসেবে নয়, বরং মানুষ হিসেবে এ সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই বোধ তাঁকে আত্ম-প্রত্যয়ী করে তোলে। তিনি ’বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক’ খলেয়া ইউনিয়ন কমিটি এবং ‘উত্তর খলেয়া সরকারটারী গ্রাম উন্নয়ন দলে’র সভাপতি নিযুক্ত হন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সেই শুরুতেই অর্থাৎ মার্চ মাসের শেষে সন্ধ্যা রাণী তাঁর গ্রাম উন্নয়ন দলের সদস্যদের সাথে সভা করেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলের সদস্যদের নিয়ে যৌথভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি দেখেন যে, সঠিক তথ্যের অভাবে মানুষ অসচেতনতার শিকারে পরিণত হয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে। গ্রামের মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে ইয়ূথ দলের সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করে তিনি পাড়ায় পাড়ায় উঠান বৈঠকের আয়োজন করেন। ইয়ূথ লিডার রোজিনা আক্তারসহ ইয়ূথ দলের সদস্যগণ এই উঠান বৈঠকগুলোতে মাস্ক ব্যবহারের গুরুত্ব, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার বজায় রাখা, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে আলোচনা করতে থাকে।

গ্রামের মানুষের মাঝে এই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের সহায়তা তিনি প্রায় শতাধিক লিফলেট বিতরণ করেছেন। আরো নিবিড়ভাবে মানুষকে জানানোর জন্যে তিনি হাত ধোয়ার ক্যাম্পেইনের আয়োজন করেন। এই ক্যাম্পেইনে তিনি নিজে ৫০জন গ্রামবাসীকে সঠিকভাবে হাত ধোয়ার কৌশল শেখানোর পাশাপাশি অতিদরিদ্র ৫০টি পরিবারে সাবান বিতরণ করেছেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারিভাবে ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণার ফলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য জেলায় কর্মরত এ গ্রামের মানুষেরা কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। ফেরত আসা এমন ব্যক্তিদের ’হোম কোয়ারেন্টাইন’ নিশ্চিত করাসহ লকডাউনের কারনে কর্মহীন হয়ে পড়া ১৫টি হতদরিদ্র পরিবারের জন্য খলেয়া ইউনিয়ন পরিষদের ত্রাণ তহবিল থেকে খাদ্যসামগ্রী (পরিবার প্রতি চাল ১০ কেজি, ডাল ২ কেজি, তেল ১লিটার ও সাবান ১টি) সংগ্রহ করে এই সকল পরিবারে পৌঁছে দিয়েছেন। একই সাথে ’সম্প্রীতি রক্ষা ও মানবিকতা বৃদ্ধিমূলক’ সভার মাধ্যমে এই পরিবারগুলোর সদস্যদের সাথে মানবিক আচরণ করার বিষয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। অপপ্রচার ও গুজব থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করার জন্য গ্রাম উন্নয়ন দলের সদস্যদের সমন্বয়ে পাড়ায় পাড়ায় সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক সভা করেছেন। তাছাড়া একান্ত বাধ্য হয়ে যারা জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামের বাইরে যাতায়াত করেন, তাদের গ্রামে প্রবেশের সময় সাবান দিয়ে হাত-পা ধোয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

সন্ধ্যা রাণী শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করেই থেমে থাকেননি। বরং যোগ্য নেতার মতো সুদূর প্রসারী চিন্তা করেছেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, দুই-এক সপ্তাহে বা মাসে করোনাভাইরাস নির্মূল হবে না। এ ভাইরাসকে প্রতিরোধ করে আমাদের ’করোনা সহিষ্ণু গ্রাম’ গড়তে হবে। আর এ জন্যে আমাদের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের বিকল্প নেই। ফলে আমাদের কৃষিকাজে মনোনিবেশ করতে হবে। কেননা, শাক-সবজি উৎপাদন না হলে গ্রামে পুষ্টির অভাব দেখা দিবে। আর তাই, গ্রামের প্রতিটি বাড়ির পতিত জমিকে ব্যবহার উপযোগী করে শাক-সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে নারীদের নিয়ে তিনি উঠান বৈঠক করেছেন। ইতিমধ্যে গ্রামের ২৫টি পরিবার নিজেদের বসতভিটায় সবজি চাষ শুরু করেছে।

করোনাভাইরাস আমাদের সামনে এক নতুন বাস্তবতা উন্মোচিত করেছে। এই বাস্তবতা এমনই ভয়াবহ যে, মানুষই মানুষের মাঝে করোনাভাইরাস সংক্রমিত করছে। আবার বিপরীতক্রমে, মানুষের নেতৃত্বই অসুস্থ মানুষকে সুস্থতার পথ দেখাচ্ছে। মানুষের ভালবাসা আক্রান্ত মানুষকে ভরসা জাগাচ্ছে। এক অদ্ভুত দ্বৈততার মাঝেও বিশ্বের প্রতিটি জনপদেই একদল স্বেচ্ছাব্রতী মানুষের নেতৃত্বে যে মানবিকতার আলো মানুষকে ভরসার পথ দেখাচ্ছে তা মানবতার ইতিহাসে অনন্য-সাধারণ হয়ে থাকবে। রংপুরের মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উত্তর-প্রজন্ম সন্ধ্যা রাণীর মতো মানুষদের গৃহীত পদক্ষেপে আমাদের এ দেশের প্রান্তিক জনপদগুলো যেমন ’করোনা সহিষ্ণু’ হবে, তেমনি মানবিকতার মাপকাঠিতে তাঁদের উদ্যোগগুলো ’বাতিঘর’ হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.