করোনাসহিষ্ণু গ্রাম গঠনে রুমেনা আক্তার ঝুনুর আত্ম-প্রত্যয়ী উদ্যোগ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্ববাসীর সামনে আজ এক নতুন বাস্তবতা। এই বাস্তবতা শুধু নতুন নয়, বরং ভয়াবহও বটে। আজ পরিবর্তিত বাস্তবতায়, আমাদের নতুনভাবে মানবিক হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

মার্চ মাসে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সনাক্তের পরে, দ্রুতগতিতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া গুজব ও ভুল তথ্য মানুষকে দিশেহারা করে। প্রস্তুতিহীন এদেশের মানুষ আতঙ্কিত হয় আরো বেশি।

বাংলাদেশের পূর্ব-অঞ্চলে সুরমা, কুশিয়ারাসহ ২৬টি নদী বিধৌত হাওর-বাওরের জেলা সুনামগঞ্জ। বাউল সাধক হাছন রাজা, রাধারমণ, শাহ আব্দুল করিমের জন্মস্থান এ জেলায় হলেও করোনাভাইরাসে সুনামগঞ্জ জেলাবাসীর আক্রান্তের হার সিলেট বিভাগের মাঝে উল্লেখযোগ্য।

সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলার মাঝে ছাতক গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। সিমেন্ট কারখানাসহ আরো উল্লেখযোগ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এ উপজেলায় অবস্থিত। ফলে প্রতিদিনই শত শত মানুষের আনাগোনা এ উপজেলা শহরে বিদ্যমান। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারিভাবে ‘’সাধারণ ছুটি’’ ঘোষণা হলে মানুষের যাতায়াত সীমাবদ্ধ হয়। কিন্তু, মানুষের বিভ্রান্তি দূর হয় না। ফলে, গুজবে কান দিয়ে এ এলাকার মানুষ দল বেঁধে মাথা ন্যাড়া করে, তেমনি আবার বিভিন্ন লতা-পাতার রস পান করতে থাকে।

ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের ‘আল-মুনির জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক রুমেনা আক্তার ঝুনু মানুষের ন্যাড়া মাথা বা লতা-পাতার রস পান করতে দেখে চিন্তিত হয়ে উঠেন। শিক্ষক হিসেবে সাধারণ মানুষের এই বিভ্রান্তি দূর করে করোনাভাইরাস সম্পর্কে তাদের সচেতন করার উপায় খুঁজতে থাকেন। মানুষের অসচেতনতা দেখে তিনি অসহায় বোধ করেন। কিন্তু একজন নারী হিসেবে তিনি কী করবেন, তা ভেবে বের করতে পারেন না। ঠিক এ রকম পরিস্থিতিতে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের ‘’নারী নেতৃত্ব বিকাশ’’ প্রশিক্ষণের কথা স্মরণ হয় তার। এ প্রশিক্ষণ থেকেই তিনি নারীনেত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করে বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক-এর ছাতক উপজেলা কমিটি ও দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। একই সাথে তিনি ‘চেচান গ্রাম উন্নয়ন দলে’র (ভিডিটি) সহ-সভাপতিও বটে।

উজ্জীবিত হয়ে উঠেন রুমেনা আক্তার ঝুনু। নেটওয়ার্ক-এর অপর সহযোদ্ধা নারীনেত্রী রাহেনা বেগম ও ঝিনুককে সাথে নিয়ে গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে উঠান বৈঠক শুরু করেন। এ সকল উঠান বৈঠকে বার বার হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরেন। সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক ৫০০ লিফলেট ও ২০টি মাস্ক এ সকল উঠান বৈঠকে তিনি বিতরণ করেন। একই সাথে চেচান গ্রামের হতদরিদ্র ৫জন গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের মাঝে নিজ উদ্যোগে পুষ্টিকর খাবার (প্রতি প্যাকেটে তেল-১ লিটার, আলু-২ কেজি, পিয়াঁজ-১ কেজি ও ময়দা-১ কেজি) বিতরণ করেন।

সাধারণ ছুটি ঘোষণার কারণে চেচান গ্রামের অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে যায়। এ সকল হতদরিদ্র পরিবারে আয়-রোজগার না থাকায় পরিবারের সদস্যরা মানবেতরভাবে জীবনযাপন করতে থাকে। এ সকল অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ঝুনু ‘চেচান গ্রাম উন্নয়ন দলে’র সভাপতি জনাব এলাছ মিয়া তালুকদারের সাথে যোগাযোগ করে সভার আয়োজন করেন। সভায় উপস্থিত সম্পাদক ফারজানা বেগম, সদস্য শাকেরা বেগমসহ সকলের আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে চেচান গ্রামের কর্মহীন হতদরিদ্র ৫০টি পরিবারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। দলের সদস্যগণ আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতিও প্রদান করেন।

সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চেচান গ্রামের কর্মহীন ৫০টি পরিবারের মাঝে রমজান মাসে ঈদের শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে খাদ্য সামগ্রী (তেল-১ লিটার, আলু-২কেজি, পিয়াঁজ-১কেজি, ছোলা-১কেজি ও ময়দা-১কেজি) প্রদান করা হয়।

শিক্ষকতা রুমেনা আক্তার ঝুনুর পেশা হলেও মানুষের প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা ঝুনুর নেশা। আর এ কারণেই চেচান গ্রামে তিনি একজন সমাজ-দরদী মানুষ হিসেবেই পরিচিত। করোনাভাইরাসের এমন দুর্যোগের দিনে তিনি মানুষের পাশে থাকবেন না, এটা ঝুনু মানতেই পারেন না। যাদের সম্পদ আছে, জনগণের সেবায় তাদেরকে এগিয়ে আসার আহ্বান করেন তিনি। ঝুনু বিশ্বাস করেন, সকলের সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব। এর জন্য সকলকে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে, আর এভাবেই বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম করোনাসহিষ্ণু গ্রাম হিসেবে গড়ে উঠবে।

ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের ‘আল-মুনির জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারি শিক্ষক রুমেনা আক্তার ঝুনু মানুষের ন্যাড়া মাথা বা লতা-পাতার রস পান করতে দেখে চিন্তিত হয়ে উঠেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.