সাফল্যগাথা

——-

গণগবেষণা সহায়ক আসমাতারা আকাশের তারার মতই দীপ্তিময়ী

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহারবাটী ইউনিয়নের প্রতিভাময়ী, প্রতিবাদী নারী কন্ঠের নাম আসমাতারা। শুধু নিজের বিকাশই নয় আশেপাশের মানুষের অবস’ার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাও যিনি গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করতেন ছোটবেলা থেকেই। এই উপলব্ধিকে বাসত্মবে রূপ দিতে ধারাবাহিকভাবে নিজ গ্রাম ও নিজ ইউনিয়নের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন প্রতিভাবান এই গণগবেষণা সহায়ক।

১৯৮১ সালে গাংনী উপজেলাধীন নিভৃত পলস্নী ভোমরদহ গ্রামে পিত্রালয়ের ঠিকানা হলেও বাবার চাকুরির সুবাদে রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন আসমা। চার বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে আসমা তৃতীয়। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় মনোযোগ আর একাগ্রতা দেখে শিক্ষকরা আসমাকে নিয়ে সাফল্যের স্বপ্ন দেখতেন। উপদেশ দিয়ে অনুপ্রেরণা যোগাতেন, উৎসাহ দিতেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য।

ধীরে ধীরে বড় হতে থাকেন আসমা। এক পর্যায়ে মায়ের সাথে নিজ গ্রাম ভোমরদহে চলে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে ভর্তি হন পার্শ্ববর্তী জোড়পুকুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া আসা, ভালই কাটছিলো স্কুলজীবন। উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখলেও আসমাকে হার মানতে হয় সামাজিক অনিয়মের কাছে। একদিন বিকেলে বান্ধবীদের সাথে খেলা শেষে বাড়ি ফিরে দেখতে পান বেশ কয়েকজন অপরিচিত মানুষ। তাৎক্ষণিকভাবে আসমা কিছু বুঝতে না পারলেও পরে নানা কথাবার্তায় বুঝতে পারেন  যে- তার বিয়ের কথা হচ্ছে। ১৯৯২ সাল। সবেমাত্র পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। এক পর্যায়ে পারিবারিক চাপে বর্শিবাড়ীয়া গ্রামের আলী আকবরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। নিমিষেই তার স্বপ্নগুলো কঠিন বাসত্মবতার কাছে হার মানে।

বিয়ের পর আসমার জীবনে শুরম্ন হয় নতুন এক অধ্যায়। বিয়ের তিন বছরের মাথায় ১৯৯৪ সালে আসমার কোলজুড়ে এলো ফুটফুটে এক পুত্রসনত্মান। নাম রাখা হলো সেলিম রেজা। একদিকে স্বামীর বেকারত্ব অন্যদিকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন পুত্রবধূকে মেনে না নেয়ার কারণে আসমা সংসারের অভাব-অনটনের সাথে পরিচিত হতে থাকেন। এক পর্যায়ে স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসেন তিনি। বেকার স্বামীর পক্ষে সংসারের পুরো দায়িত্ব নেয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। তাই দু’জনে পরামর্শ করে সংসারের আয় বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। এক আত্মীয়ের পরামর্শে পাশের গ্রাম ধর্মচাকী গ্রামের নজরম্নল ইসলামের নিকট কাপড় সেলাইয়ের কাজ শেখেন। এক পর্যায়ে আসমার বাবা তাকে একটি সেলাই মেশিন ও কিছু টাকার কাপড় কিনে দেন। সেলাইয়ের কাজ করে ভালই কাটছিলো তিন জনের সংসার।

শ্বশুর-শাশুড়ির চাপে আসমার স্বামী হঠাৎ একদিন বাবার কাছে চলে যায়। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত তার সংসার ভেঙ্গে যায়। এক পর্যায়ে ২০০১ সালের ২০ মার্চ তারিখে স্বামীর অকাল মৃত্যু হয়। শিশু সনত্মানকে নিয়ে অথৈ পাথারে নিমজ্জিত হন আসমা। কি করবেন তিনি? কোনো কূল-কিনারা খুঁজে না পেয়ে চরম হতাশায় কাটতে থাকে আসমার দিন। এরই মধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের পরামর্শে ছেলেটাকে বুকে ধরে আশা নিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করেন আসমা। দিনে দিনে বড় হতে থাকে ছেলে। দ্বিতীয় বিয়ের কথা না ভেবে ছেলেটাকে মানুষ বানানোর প্রত্যয় লালন করতে থাকেন আসমা। দৃঢ় প্রত্যয়  নিয়ে সংসারের হাল ধরেন। পড়াশুনার পাশাপাশি বাড়িতে বসে দর্জির কাজ করে এবং হাঁস-মুরগি পালন ও মাছ চাষ করে তার আর্থিক সংস’ানের ব্যবস’া করতেন। এক বেলা খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্ট করে ছেলের এবং নিজের পড়াশুনার খরচ যোগাড় করতেন। এ সময় নিজেকে আরও শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে ভর্তি হন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০১৩ সালে এসএসসি পাশের পর ভর্তি হন একাদশ শ্রেণিতে। অন্যদিকে ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করার লক্ষ্যে প্রথমে রাজধানী ঢাকার গণভবন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। এখান থেকে এসএসসি পাশ করার পর ছেলে ভর্তি হয় হয় ডেফোডিল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশ করে। বর্তমানে এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করছে।

গ্রামের হত দরিদ্র মানুষের সেবা করার লক্ষ্যে আসমা ২০০৩ সালে সাহারবাটী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। প্রথমবার পরাজিত হলেও দ্বিতীয়বার ২০১১ সালের ১৮ জুন বিপুল ভোটের ব্যবধানে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। আসমা বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে জনসেবা করে যাচ্ছেন। নিজের উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি ছেলের উচ্চশিক্ষা অর্জনের তীব্র ইচ্ছাও পূরণ করে চলেছেন।

এমনি করে পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষে চলছিলো আসমাতারার জীবন। ২০১২ সালে হঠাৎ সাক্ষাৎ হয়  দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ-এর ইউনিয়ন সমন্বয়কারী আমিরম্নল ইসলাম অল্ডামের সাথে। হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শুনে আসমা ঐকমত্য প্রকাশ করে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে যশোরে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত ‘নারী নেতৃত্ব বিকাশ’ শীর্ষক নারীনেত্রীদের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন বিষয়ক আলোচনা আসমাকে আকৃষ্ট করে। তিনি বুঝতে পারেন- জীবনে কাঙ্খিত সফলতা অর্জন করতে হলে আত্মবিশ্বাসী ও পরিশ্রমী হতে হবে। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক এর সদস্য হিসাবে নিজ গ্রাম তথা ইউনিয়নে পিছিয়ে পড়া হত দরিদ্র নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৩ সালে আসমা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-এর তিন দিনব্যাপী এক গণগবেষণা কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালায় তিনি যৌথভাবে চিনত্মা করার শক্তির বিষয়টি উপলব্ধি করেন। যৌথভাবে চিনত্মা করলে যে কোনো সমস্যার সবচাইতে ভালো সমাধান করা যায়- এই বিষয়টিও তার উপলব্ধিতে আসে। তবে এরজন্য প্রয়োজন কোনো বিষয়ে পদ্ধতিগতভাবে অনুসন্ধান করা। আর এই প্রক্রিয়াই গণগবেষণা। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে শেখেন এবং সেই শিক্ষা নিজের জীবনে ও সমাজ পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করেন। আসমা পাঁচটি সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে পাঁচটি পরিবারের কর্মসংস’ানের সৃষ্টি করেছেন।

একজন সফল গণগবেষণা সহায়ক আসমা প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে গণসংগঠনে যৌথ চিনত্মার চর্চা শুরম্ন করেন। তিনি বর্তমানে গণসংগঠনের নারীদের একতাবদ্ধ তথা সংগঠিত করে সামাজিক বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। একই সাথে আসমা তার গণসংগঠনের ১৫ জন পিছিয়ে পড়া নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে আয়মুখী উদ্যোগ গ্রহণে সম্পৃক্ত করেছেন। একটি আদর্শ গ্রাম গড়ে তুলতে সকল শিশুকে স্কুলগামী করা, সকল পরিবারের জন্য স্বাস’্যসম্মত পায়খানা ও নিরাপদ পানি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধকরণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সমিতি বা সংগঠন গড়ে তুলতে পিছিয়ে পড়া নারীদের সহযোগিতা প্রদান এবং সকল ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে চলেছেন আসমা ।

আসমা তিনটি গণসংগঠন গড়ে তুলে ৬৫ জন নারীকে নানা ধরনের আয়মুখী কাজের সাথে যুক্ত করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদে ‘জয়িতা’ ও ‘অপরাজিতা’ নারী সংগঠক হিসেবে গাংনী উপজেলার শ্রেষ্ঠ সংগঠক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। পেয়েছেন পদক ও সম্মাননা। আসমাতারা এখন নিজেই স্বাবলম্বী। সমাজে রয়েছে তার মর্যাদা। তাকে অনুসরণ করে অনেক নারীই এখন বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আসমার উজ্জ্বল আলোতে এখন অনেকেই আলোকিত।